নামজারি খতিয়ান চেক : ঘরে বসে জমির মালিকানা যাচাই

বাংলাদেশে জমির মালিকানা নির্ধারণ এবং যাচাইকরণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ডিজিটাল যুগে এসে সরকার ভূমি সেবাকে অনলাইনে নিয়ে এসেছে, যার ফলে এখন ঘরে বসেই নামজারি খতিয়ান চেক করা সম্ভব হয়েছে। নামজারি খতিয়ান চেক করা এখন খুবই সহজ হয়েছে এবং মাত্র কয়েকটি তথ্য প্রদান করে অনলাইনে জমির মালিকানা যাচাই করা যায়।

বাংলাদেশ সরকারের ভূমি মন্ত্রণালয় ই-নামজারি, ডিজিটাল রেকর্ড রুম, ভূমি উন্নয়ন কর সহ বিভিন্ন অনলাইন সেবা চালু করেছে। এই ডিজিটাল রূপান্তরের ফলে জমির মালিকরা এখন আর ভূমি অফিসে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয় না।

নামজারি খতিয়ান কী?

নামজারি খতিয়ান হলো জমির মালিকানা পরিবর্তনের পর তৈরি হওয়া একটি নতুন ভূমি রেকর্ড। যখন কোনো জমি ক্রয় করার পরে সেটির মালিকানা নিজের নামে নিবন্ধিত করার জন্য নামজারি আবেদন করা হয়, তখন একজন প্রদত্ত কর্মকর্তা একটি নতুন খতিয়ান তৈরি করেন যেখানে নতুন দখলদার বা মালিকানার তথ্য উল্লেখ থাকে।

নামজারি খতিয়ানের বৈশিষ্ট্য:

  • নতুন মালিকানা: জমির বর্তমান মালিকের নাম ও তথ্য
  • পূর্ববর্তী তথ্য: আগের মালিকের তথ্য এবং দাগ নম্বর
  • হালনাগাদ রেকর্ড: সর্বশেষ আপডেট করা তথ্য
  • আইনি বৈধতা: মালিকানার আইনি প্রমাণ

নামজারি খতিয়ান চেক করার গুরুত্ব

১. মালিকানা নিশ্চিতকরণ

জমি ক্রয় করার পর সেটি আপনার নামে সঠিকভাবে নিবন্ধিত হয়েছে কিনা তা যাচাই করা অত্যন্ত জরুরি।

২. আইনি সুরক্ষা

নামজারি খতিয়ান জমির মালিকানা প্রমাণের গুরুত্বপূর্ণ দলিল যা জমির নামজারি বা কেনা-বেচা এমনকি আরো অনেক ক্ষেত্রে দরকার হতে পারে।

৩. জমি বিক্রয়ের সুবিধা

ভবিষ্যতে জমি বিক্রয় করার সময় সঠিক নামজারি খতিয়ান অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

৪. ঋণ গ্রহণের সুবিধা

ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়ার সময় নামজারি খতিয়ান জামানত হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

Related: আর এস খতিয়ান অনুসন্ধান

নামজারি খতিয়ান চেক করার পূর্বে প্রয়োজনীয় তথ্য

নামজারি খতিয়ান অনুসন্ধান করার জন্য নিম্নলিখিত তথ্যগুলি প্রয়োজন:

প্রয়োজনীয় তথ্য বিবরণ
বিভাগ আপনার জমি কোন বিভাগে অবস্থিত (ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ইত্যাদি)
জেলা জমির অবস্থানের জেলা
উপজেলা সংশ্লিষ্ট উপজেলা
মৌজা জমির মৌজার নাম (এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ)
খতিয়ান নম্বর জমির খতিয়ান নম্বর
দাগ নম্বর জমির দাগ নম্বর
মালিকের নাম জমির মালিকের নাম

স্টেপ বাই স্টেপ নামজারি খতিয়ান চেক করার পদ্ধতি

পদ্ধতি ১: সরকারি ওয়েবসাইট ব্যবহার করে

ধাপ ১: ওয়েবসাইটে প্রবেশ নামজারি খতিয়ান চেক করার জন্য https://land.gov.bd/ ওয়েবসাইটে ভিজিট করুন।

ধাপ ২: ভূমি রেকর্ড ও ম্যাপ নির্বাচন ভূমি রেকর্ড ও ম্যাপ অপশনে ক্লিক করুন এবং নামজারি খতিয়ান অপশন বাছাই করুন।

ধাপ ৩: এলাকার তথ্য প্রদান জমির বিভাগ, জেলা ও উপজেলা বাছাই করুন।

ধাপ ৪: মৌজা নির্বাচন খতিয়ানের ধরণ ও মৌজা বাছাই করতে হবে।

ধাপ ৫: অনুসন্ধান সম্পন্ন করুন খতিয়ান নং দিয়ে খুজুন বাটনে ক্লিক করুন।

পদ্ধতি ২: ই-পর্চা পোর্টাল ব্যবহার করে

ধাপ ১: ই-পর্চা ওয়েবসাইটে যান https://eporcha.gov.bd/ ওয়েবসাইটে প্রবেশ করুন।

ধাপ ২: নামজারি খতিয়ান অপশন নির্বাচন মোট ৫টি অপশন থেকে নামজারি খতিয়ান অপশনটি বাছাই করুন।

ধাপ ৩: এলাকার তথ্য প্রদান আপনার বিভাগ, জেলা এবং উপজেলা বাছাই করুন।

ধাপ ৪: মৌজা নির্বাচন আপনার মৌজা বা এলাকা বাছাই করুন। মৌজার নাম নিশ্চিত হয়ে নিন।

ধাপ ৫: খতিয়ান অনুসন্ধান নামজারি খতিয়ান নাম্বার বসিয়ে “খুজুন” বাটনে ক্লিক করুন।

পদ্ধতি ৩: DLRMS পোর্টাল ব্যবহার করে

ধাপ ১: DLRMS ওয়েবসাইটে যান dlrms.land.gov.bd ওয়েবসাইটে প্রবেশ করুন।

ধাপ ২: নামজারি খতিয়ান সিলেক্ট করুন ট্যাব থেকে নামজারি খতিয়ান সিলেক্ট করুন।

ধাপ ৩: খতিয়ানের তথ্য প্রদান খতিয়ানের বিভিন্ন তথ্য দিয়ে অনুসন্ধান করুন।

নামজারি খতিয়ান চেক করার বিকল্প পদ্ধতি

মালিকের নাম দিয়ে অনুসন্ধান

সার্চ বক্সে জমির মালিকের নাম লিখে খুজুন বাটনে ক্লিক করে নামজারি খতিয়ান যাচাই করতে পারবেন।

দাগ নম্বর দিয়ে অনুসন্ধান

খতিয়ান নাম্বার দিয়ে নামজারি খতিয়ান যাচাই করতে না পারলে মালিকের নাম এবং দাগ নাম্বার দিয়ে চেষ্টা করুন।

নামজারি আবেদনের স্ট্যাটাস চেক করা

আবেদনের সর্বশেষ অবস্থা যাচাই

নামজারি আবেদন চেক করার জন্য https://mutation.land.gov.bd এ যান এবং “আবেদনের সর্বশেষ অবস্থা” অপশনে যান।

প্রয়োজনীয় তথ্য

বিভাগ বাছাই করে আবেদনের আইডি ও জাতীয় পরিচয় পত্র নম্বর লিখুন।

নামজারি প্রক্রিয়ার সময়সীমা

সাধারণত একটি জমির নামজারি প্রক্রিয়া ২৮ দিনের মধ্যে নিস্পত্তি হয়ে থাকে। সহকারী কমিশনার ভূমি এই আবেদনের চূড়ান্ত অনুমোদনের আদেশ করার পর আপনার নামে অনলাইনে খতিয়ান প্রস্তুত করা হবে।

নামজারি খতিয়ান ডাউনলোড করার পদ্ধতি

সার্টিফাইড কপি সংগ্রহ

খতিয়ান আবেদনে ডাবল ক্লিক করে আপনার জাতীয় পরিচয় পত্র নম্বর উল্লেখ করে সিলেক্ট করুন আপনি অনলাইন কপি সংগ্রহ করবেন নাকি সার্টিফাইড কপি।

পেমেন্ট প্রক্রিয়া

আপনার সুবিধামতো পেমেন্ট অপশন সিলেক্ট করে পরবর্তী ধাপে গিয়ে ফি পরিশোধ করলে নামজারি খতিয়ান ডাউনলোড করতে পারবেন।

DCR ফি

খতিয়ান প্রস্তুত হলে DCR ফি হিসেবে ১১০০ টাকা প্রদান করতে হবে।

সাধারণ সমস্যা ও সমাধান

সমস্যা ১: মৌজা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না

সমাধান: মৌজার সঠিক বানান নিশ্চিত করুন এবং স্থানীয় ভূমি অফিসে যোগাযোগ করুন।

সমস্যা ২: খতিয়ান নম্বর দিয়ে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না

সমাধান: মালিকের নাম এবং দাগ নম্বর দিয়ে অনুসন্ধান করুন।

সমস্যা ৩: ওয়েবসাইট লোড হচ্ছে না

সমাধান: ভিন্ন ব্রাউজার ব্যবহার করুন বা পরে চেষ্টা করুন।

নামজারি খতিয়ান চেক করার সুবিধা

১. সময় সাশ্রয়

এভাবেই খুব সহজে নামজারি খতিয়ান চেকিং করতে পারবেন মাত্র ১ মিনিটে নিজের মোবাইল দিয়ে।

২. খরচ সাশ্রয়

ভূমি অফিসে যাওয়ার পরিবহন খরচ সাশ্রয়।

৩. ২৪/৭ সেবা

যেকোনো সময় অনলাইনে চেক করা যায়।

৪. স্বচ্ছতা

সরকারি তথ্য সরাসরি পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের ভূমি রেকর্ড পরিসংখ্যান

বিবরণ সংখ্যা
মোট মৌজা প্রায় ৬৮,০০০+
ডিজিটাল খতিয়ান ৮৫% এর বেশি
অনলাইন নামজারি ৯০% এর বেশি
গড় প্রক্রিয়াকরণ সময় ২৮ দিন

ভূমি সেবার ডিজিটাল রূপান্তর

বাংলাদেশের ভূমি মন্ত্রণালয় ২০২২ সালে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যার কারণে এখন তাদের অনেক সেবা অনলাইনে পাওয়া যায়।

অনলাইন সেবাসমূহ:

  • অনলাইন খতিয়ান যাচাই
  • খতিয়ান পাওয়ার জন্য আবেদন
  • ভূমি উন্নয়ন কর প্রদান
  • অনলাইন ভূমির নামজারি
  • মিউটেশন বা খারিজ আবেদন

মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন

ভূমি মন্ত্রণালয় মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন চালু করেছে যার মাধ্যমে ভূমি সেবা নেওয়া যায়।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)

১. নামজারি খতিয়ান চেক করতে কি কোনো ফি লাগে?

উত্তর: না, নামজারি খতিয়ান চেক করা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। তবে সার্টিফাইড কপি ডাউনলোড করতে ফি লাগে।

২. নামজারি খতিয়ান চেক করতে কতক্ষণ সময় লাগে?

উত্তর: অনলাইনে নামজারি খতিয়ান চেক করতে মাত্র ১-২ মিনিট সময় লাগে।

৩. যদি আমার নামজারি খতিয়ান অনলাইনে পাওয়া না যায়?

উত্তর: এক্ষেত্রে আপনার স্থানীয় ভূমি অফিসে যোগাযোগ করুন। হয়তো আপনার নামজারি প্রক্রিয়া এখনও সম্পন্ন হয়নি।

৪. নামজারি খতিয়ান এবং সার্ভে খতিয়ানের মধ্যে পার্থক্য কি?

উত্তর: সার্ভে খতিয়ান হলো সরকার কর্তৃক পরিচালিত ভূমি সার্ভের ভিত্তিতে তৈরি একটি রেকর্ড, যা ভূমির প্রাথমিক মালিকানা প্রদান করে। অন্যদিকে, নামজারি খতিয়ান হলো জমির মালিকানা বা ব্যবহারে কোনো পরিবর্তন ঘটার পর সেটির হালনাগাদ রেকর্ড।

৫. নামজারি আবেদনের পর কখন খতিয়ান প্রস্তুত হয়?

উত্তর: নামজারি আবেদন অনুমোদন হলে আপনার নামে খতিয়ান প্রস্তুত হবে এবং তখন অনলাইনে আপনার নাম দিয়ে খতিয়ান অনুসন্ধান করতে পারবেন।

৬. কোন তথ্যগুলি ভুল হলে নামজারি খতিয়ান খুঁজে পাওয়া যাবে না?

উত্তর: বিভাগ, জেলা, উপজেলা, মৌজা, খতিয়ান নম্বর, বা মালিকের নাম ভুল হলে খতিয়ান খুঁজে পাওয়া যাবে না।

৭. নামজারি খতিয়ান কি মোবাইল দিয়ে চেক করা যায়?

উত্তর: হ্যাঁ, মোবাইল ফোন দিয়ে অনলাইনে নামজারি খতিয়ান চেক করা যায়।

৮. নামজারি খতিয়ান প্রিন্ট করতে কত টাকা লাগে?

উত্তর: সার্টিফাইড কপি প্রিন্ট করতে DCR ফি হিসেবে ১১০০ টাকা প্রদান করতে হয়।

৯. নামজারি খতিয়ান চেক করার জন্য কোন সময় ভালো?

উত্তর: যেকোনো সময় চেক করা যায়, তবে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত সার্ভার কম লোড থাকে।

১০. আমার নামজারি আবেদন কতদিন ধরে পেন্ডিং আছে, এটি কিভাবে জানবো?

উত্তর: mutation.land.gov.bd সাইটে “আবেদনের সর্বশেষ অবস্থা” অপশনে আবেদন আইডি দিয়ে চেক করুন।

গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইট লিংক

সেবা ওয়েবসাইট
নামজারি খতিয়ান চেক https://land.gov.bd/
ই-পর্চা https://eporcha.gov.bd/
নামজারি আবেদন https://mutation.land.gov.bd/
DLRMS https://dlrms.land.gov.bd/
ভূমি মন্ত্রণালয় https://minland.gov.bd/

উপসংহার

নামজারি খতিয়ান চেক করা এখন আর জটিল কোনো বিষয় নয়। সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প অনুযায়ী ভূমি সেবা এখন সবার হাতের মুঠোয়। মাত্র কয়েকটি সহজ ধাপ অনুসরণ করে আপনি ঘরে বসেই আপনার জমির নামজারি খতিয়ান যাচাই করতে পারেন।

এই অনলাইন সেবার মাধ্যমে সময়, অর্থ এবং শ্রম সাশ্রয় হচ্ছে। পাশাপাশি দুর্নীতি রোধে এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধিতেও এই ডিজিটাল সেবা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

জমির মালিক হিসেবে আপনার উচিত নিয়মিত আপনার নামজারি খতিয়ান চেক করা এবং সঠিক তথ্য নিশ্চিত করা। এতে করে ভবিষ্যতে যেকোনো আইনি জটিলতা থেকে বেঁচে থাকা যাবে।

মনে রাখবেন, আপনার জমি আপনার সম্পদ। এই সম্পদের সুরক্ষার জন্য নিয়মিত নামজারি খতিয়ান চেক করুন এবং সবসময় হালনাগাদ তথ্য রাখুন।

Leave a Comment